তথ্য প্রযুক্তি (Information Technology বা IT) আজকের বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বাংলাদেশও এ প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে গত এক দশকে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশের সর্বস্তরে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুই এখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে। এই লেখায় আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো, তথ্য প্রযুক্তি বর্তমান বাংলাদেশে কীভাবে সাড়া ফেলেছে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো কী।
২০০৯ সালে বর্তমান সরকার "ডিজিটাল বাংলাদেশ" রূপকল্প ঘোষণা করে। সেই সময়ে অনেকেই এটিকে কল্পনার কিছু মনে করলেও আজ তার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি সেবা ডিজিটাল হচ্ছে, অনলাইন পোর্টাল থেকে নানান কাগজপত্র সংগ্রহ সম্ভব, এমনকি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এখন বিদ্যুৎ বিল প্রদান, ট্যাক্স ফাইলিং, ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবা গ্রহণ করা যায়।
জাতীয় তথ্য বাতায়ন (www.bangladesh.gov.bd) এবং ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC) গুলোর মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও এখন সরকারি সেবা পাচ্ছে সহজে ও দ্রুত। এটি শুধু সময় এবং খরচ সাশ্রয় করছে না, বরং দুর্নীতিও হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্স এখন বাস্তব। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ওয়েবসাইটে নাগরিক সেবা ডিজিটালভাবে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন:
অনলাইনে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন
ভূমি সংক্রান্ত তথ্য ও নামজারি
পাসপোর্ট আবেদন ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্স
আদালতের রায় অনুসন্ধান ও কেস ট্র্যাকিং
এসবের ফলে জনসাধারণের হয়রানি কমেছে এবং সেবা গ্রহণের গতি বেড়েছে।
শিক্ষা খাতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাকালে অনলাইন ক্লাস ও ভার্চুয়াল পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। যেমন:
Zoom, Google Meet ও Microsoft Teams এর মাধ্যমে ক্লাস
শিখন প্ল্যাটফর্ম (সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের উদ্যোগে)
বিভিন্ন MOOC (Massive Open Online Course) এবং অনলাইন কোর্সের জনপ্রিয়তা
এছাড়া, প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি শেখার জন্য তরুণরা YouTube, Coursera, Udemy-এর মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং জাতি। তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক কাজ যেমন ওয়েব ডিজাইন, ডেটা এন্ট্রি, কন্টেন্ট রাইটিং, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি করে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
২০১৯ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৬ লাখের বেশি নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার রয়েছে এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ICT Division, BASIS, LICT এর মতো বিভিন্ন সংস্থা তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ফ্রিল্যান্সার তৈরিতে কাজ করছে।
তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছে। Daraz, Rokomari, Pickaboo, Evaly (সাবেক), এবং হাজার হাজার ছোট-বড় ফেসবুকভিত্তিক পেজ এখন অনলাইন কেনাকাটার জনপ্রিয় মাধ্যম।
বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তারা এখন অনলাইনে পণ্য ও সেবা বিক্রয় করছে। Shopify, WooCommerce, Facebook Shops ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে কাজ করে উদ্যোক্তারা নিজের ব্যবসা দাঁড় করাচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এই খাতকে আরও সহজ করেছে।
bKash, Nagad, Rocket এর মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এখন লাখ লাখ মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। এর মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জের মানুষও ডিজিটাল পেমেন্টে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। শুধু টাকা পাঠানোই নয়, এখন বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, অনলাইন কেনাকাটা এমনকি ক্ষুদ্র বিনিয়োগও এই মাধ্যমে করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্টার্টআপ কালচার দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। Ride-sharing (Pathao, Uber), Food delivery (Foodpanda, HungryNaki), Logistics (Paperfly, RedX), Fintech (bKash, iFarmer) সহ অনেক ক্ষেত্রেই নতুন উদ্যোগ আসছে।
২০১৫ সালে চালু হওয়া ‘Startup Bangladesh’ উদ্যোগ এখন স্টার্টআপদের বিনিয়োগ সহায়তা এবং ইনকিউবেশন প্রোগ্রাম প্রদান করছে। দেশের তরুণরা এখন আর শুধু চাকরি খোঁজে না, বরং নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে চায়।
তথ্য প্রযুক্তির এত সাফল্যের মাঝেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যেমন:
ইন্টারনেট স্পিড ও ব্যান্ডউইথ সমস্যা
সাইবার নিরাপত্তার অভাব
ডিজিটাল লিটারেসির ঘাটতি
গ্রামাঞ্চলে প্রযুক্তি অবকাঠামো দুর্বলতা
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে যদি সরকার এবং বেসরকারি খাত একসাথে কাজ করে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি আইটি-ভিত্তিক উন্নয়নশীল দেশ হয়ে উঠতে পারে।
তথ্য প্রযুক্তি বাংলাদেশের উন্নয়নের একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা ও কর্মসংস্থান—সব কিছুতেই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। তরুণ সমাজ এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। আজকের এই গ্লোবাল প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তিকে আপন করে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তথ্য প্রযুক্তিকে দক্ষভাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ একটি স্মার্ট, উদ্ভাবনী ও আত্মনির্ভর দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে পারবে।
মন্তব্য করুন